জ্বর প্রসঙ্গে কিছু কথা:

জ্বর কোনো রোগ নয় বরং রোগজীবাণুকে নষ্ট করার একটি প্রয়াস। জ্বর হলো শরীরের বর্ধিত উষ্ণতা তথা আরোগ্যের অগ্নিস্নান।

আমাদের শরীরের অভ্যন্তরে কোনো দুষ্ট ভাইরাস প্রবেশ করলে, তাকেই বলে ভাইরাল ইনফেকশন। এই ভাইরাল ইনফেকশন হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। ভাইরাস ছড়িয়ে আছে পরিবেশে যত্রতত্র সর্বত্র, জলে, স্থলে, বায়ুমণ্ডলে। ভাইরাস ছড়িয়ে থাকতে পারে যে কোন প্রাণীর দেহে, সেই প্রাণীটি হতে পারে কীটপতঙ্গ, পশু, পাখি, মনুষ্য বা মৎস্যাদি।

ভাইরাস হলো একটা অণুজীব বা ক্ষুদ্র জীবাণু। জীবজগতে ভাইরাসের মোট সংখ্যা অবশ্যই অসংখ্য। তবুও বিজ্ঞানীদের মতে আনুমানিক সংখ্যাটা হলো ১০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০ (১×১০^৩১)। আসলে আমাদের চারপাশে এত বিপুল ভাইরাস ছড়িয়ে আছে যে, আমরা যেন ভাইরাসের সমুদ্রে ডুবে আছি।

ভাইরাসের উপকারিতা-
ভাইরাস হল জীবদেহের এক নিত্য সহচর, জীবজগতের পরম বন্ধু। জৈবিক বাস্তুতন্ত্রে এদের গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল ভূমিকা রয়েছে, যা জীবনের অস্তিত্ব ও ভারসাম্য রক্ষায় অপরিহার্য। এক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের নিজস্ব কোষের সংখ্যা প্রায় ৩০ ট্রিলিয়ন, কিন্তু এর সাথে থাকে ৩৯ ট্রিলিয়ন ব্যাকটেরিয়া এবং ৩৮০ ট্রিলিয়ন ভাইরাস (১ ট্রিলিয়ন=১ লক্ষ কোটি)। অর্থাৎ মানবদেহের জৈবিক অস্তিত্বের মূলে আছে জীবাণু। এই জীবাণু সমূহকে বলা হয় মাইক্রোবায়োম (Microbiome)। এরা আমাদের শরীরের জৈবিক কার্যকলাপ ত্বরান্বিত করে।
যেমন একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের পেটের মধ্যে প্রায় ১.৫ কেজি জীবাণু উপস্থিত থাকে, এরা যেমন খাদ্য হজমে বা কঠিন গ্লুকোজ সংশ্লেষণে সাহায্য করে, তেমনি স্নায়ুসূত্রে গুরুত্বপূর্ণ সংকেত প্রেরণ করে- যার দ্বারা মস্তিষ্ক সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

বিজ্ঞানীরা এপর্যন্ত ১৬০০০ প্রজাতির ভাইরাস সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেছেন। এদের মধ্যে মাত্র ২০০ প্রকার ভাইরাস দুষ্টুমি করতে পারে। যার ফলে আমাদের শরীরে ক্ষণস্থায়ী সামান্য উপসর্গ দেখা যেতে পারে, যেমন- জ্বর, গায়ে ব্যথা, দুর্বলতা, সর্দি-কাশি। কিন্তু কোনো কঠিন রোগব্যাধি সৃষ্টি করতে পারে না। এই ভাইরাস আদৌ ভয়ানক নয়, মারাত্মকও নয়। বরং মানুষের শরীরে অনুপ্রবেশ করলেও এরা মাত্র ৭ দিনের মধ্যে মারা পড়ে।

মানবদেহে কিভাবে সৃষ্টি হয় জ্বর?
জ্বর কোনো রোগ নয়, বরং রোগজীবাণুকে দমন করার এক সফল প্রয়াস, যা কিনা ইমিউন সিস্টেমের বিশেষ প্রতিক্রিয়া। মানবদেহের গড় তাপমাত্রা ৯৮°- ৯৯° F. যদি এই তাপমাত্রা কমপক্ষে ১০১° ফারেনহেটে পৌঁছে যায় তবে জ্বর বলে গণ্য করা হয়।

যখন আমাদের শরীরে কোনো জীবাণু (যেমন - ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, প্যাথোজেন ইত্যাদি) অনুপ্রবেশ করে, তখন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে ওঠে, এবং জীবাণু গুলোকে সনাক্ত করে ফেলে ইমিউন কোষ- যেমন ম্যাক্রোফেজ (macrophages) ও ডেনড্রাইটিক কোষ (dendritic cells)। এরপর তারা নিঃসরণ করে সাইটোকাইন (Cytokine IL-1, IL-6), এই সাইটোকাইন উচ্চ উষ্ণতার সংকেত বহন করে রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে পৌঁছে যায় মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসে (hypothalamus), এটি শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। হাইপোথ্যালামাস তখন থার্মোরেগুলেটরি সেট পয়েন্টকে (thermoregulatory set point) বাড়িয়ে দেয় ১০৩°- ১০৪° ফারেনহাইটে, যা কিনা উষ্ণতা বৃদ্ধির এক নির্দেশ। তখন প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ একযোগে উষ্ণতা বৃদ্ধির যজ্ঞে ঘৃতাহুতি প্রদান করে। ফলত তাপমাত্রা পৌঁছে যায় ১০২°-১০৩° ফারেনহাইটে, এটাই হলো জ্বর।

সংক্রমণকারী ভাইরাস মারা পড়ে কিভাবে?
শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় সংক্রমণকারী ভাইরাস গুলো বেঁচে থাকে ও বংশ বৃদ্ধি করে। কিন্তু মানবশরীর জ্বরের মাধ্যমে ২°- ৪° ফারেনহাইট তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়, তখন এই উচ্চতাপ সহ্য করতে না পেরে ভাইরাসগুলো মারা পড়ে। অতঃপর আক্রান্ত ব্যক্তিও সুস্থ হয়ে ওঠেন। তাইতো জ্বর মানে আরোগ্যকারী উষ্ণতা।

এখন একটি প্রশ্ন-  জ্বরের উচ্চতাপে যদি অনুপ্রবেশকারী ক্ষতিকারক ভাইরাসগুলি মারা যায় তাহলে শরীরের মধ্যে উপস্থিত থাকা কোটি কোটি উপকারী ভাইরাস গুলোও তো মারা যেতে পারে?
উত্তর-  উপকারী ভাইরাস গুলো আমাদের দেহে বরাবর উপস্থিত আছে, অর্থাৎ তারা শরীরের তাপমাত্রা তারতম্যের সাথে পরিচিত ও অভিযোজিত। তারা বহু বছর ধরে জ্বরের সঙ্গে উচ্চতাপের বিরুদ্ধে সহনশীলতা অর্জন করেছে। তবে হ্যাঁ, কিছু সংখ্যক ভাইরাস ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা মারা যেতে পারে। কিন্তু জ্বর সেরে যাওয়ার পরে তারা খুব দ্রুত পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়ে ওঠে।

সাধারণত ভাইরাল সংক্রমণ বা ফ্লু (flu- influenza like illness) হলে একটি প্রধান উপসর্গ দেখা যায়- জ্বর। তবে কিছু অন্যান্য কারণেও জ্বর হতে পারে, সেক্ষেত্রে মূল রোগটিকে খুঁজে বার করতে হবে এবং তার চিকিৎসা করাতে হবে।
অতএব প্রয়োজন হলে সঠিক চিকিৎসকের পরামর্শ নিতেই পারেন। আজও প্রচলিত আছে বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা পদ্ধতি, যেমন আয়ুর্বেদ হোমিওপ্যাথ ন্যাচারোপ্যাথ যোগ-চিকিৎসা ইত্যাদি।
Medical disclaimer-
এই প্রতিবেদনে প্রদত্ত তথ্য শুধুমাত্র স্বাস্থ্য বিষয়ে শিক্ষামূলক উদ্দেশ্যে উপস্থাপন করা হয়েছে। আতএব কোনো রোগের চিকিৎসা ও ওষুধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
                      ~ রাম রানা

মন্তব্যসমূহ