শিক্ষক ও শিক্ষাব্যবস্থা:

শিক্ষক কেবল একটি শব্দ নয়, বরং বিদ্যার অনুপম স্বরূপ। তিনি শুধু নিছক পাঠ দানকারী নন, তাঁর প্রতিটি উচ্চারণ সত্যের উপস্থাপন, বোধ বিতরণ যার অটল সাধনা। তিনি জ্ঞানের বুনিয়াদ, সভ্যতার স্থপতি।

বর্তমানে পশ্চিমবাংলায় চাকরিহারা শিক্ষাকর্মীরা নেমেছেন রাজপথে পুনরায় চাকরির দাবিতে তথা বেতনের দাবিতে। কিন্তু শিক্ষক কারোর চাকর হতে পারেন কি? শিক্ষক কারোর বেতনভুক্ত কর্মচারী হতে পারেন কি? না, কখনোই নয়। কারণ, শিক্ষক জ্ঞানের গরিমা, স্ততঃ উদ্ভাসিত এক চেতনা। তাইতো বিনম্র বিশ্ব অবনত হয়েছে শিক্ষকের চরণতলে। শিক্ষার্থীর কোমল হৃদয়ে শিক্ষকের পদ্মাসন।

আজ শিক্ষককের প্রসঙ্গে উঠেছে প্রশ্ন- যোগ্য বা অযোগ্য নাকি দুর্নীতি? অযোগ্য বলেই তাদেরকে চাকরি থেকে বহিঃসৃত করা হয়েছে। তাহলে জবাব কেউ দিতে পারবে কি, যেসব শিক্ষা কর্মীরা বর্তমানে চাকরিতে বহাল আছেন তারা কি অযোগ্য নয়? শিক্ষকের যোগ্যতার মান আদালত নির্ধারণ করতে পারে না, নিয়োগকারিগণ নির্ধারণ করতে পারে না। শিক্ষকের যোগ্যতার মান কোনো দপ্তরের দস্তাবেজ নয়। কারণ শিক্ষক মানে স্বশিক্ষিত তথা সম্যক জ্ঞানের অধিকারী। 

পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ, পুরুষোত্তম শ্রীরামও শিক্ষকের সান্নিধ্যে এসেছিলেন। শিক্ষক সভ্যতার প্রজ্ঞা, সর্বজনের পূজনীয়।
সূর্যের নিচে শিক্ষক দ্বিতীয় দীপ্তিমান নক্ষত্র। ছাত্রের জিজ্ঞাসু অন্তঃস্থলে শিক্ষক এক জ্যোতির্ময় জবাব।

এমতাবস্থায় শিক্ষাকর্মীগণ যদি চাকরির চাহিদায় রাস্তায় অবতীর্ণ হন, তবে কি শিক্ষকের আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ন হয় নি? তবে কি শিক্ষার চেতনা লজ্জা পায়নি? বেতনের প্রলোভনে শিক্ষা কর্মীদের আন্দোলন কি অশোভনীয় নয়?
শিক্ষক কোনোদিন ভিক্ষুক নন। যিনি লাভ করেছেন অমূল্য বিদ্যাবৈভব, তার চরণতলে তুচ্ছ সাত রাজার ধন। শিক্ষকের প্রকৃত মর্যাদা বেতনের ঊর্ধ্বে। শিক্ষক আদরনীয় চিরদিন মানবতার অন্তরে।
অতএব কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পদ অথবা প্রতিষ্ঠার মোহ শিক্ষককে বিচলিত করতে পারে না, কারণ তিনি অবিচলিত জ্ঞানের দৃঢ়তায়। তাই আন্দোলন হোক অশিক্ষার বিরুদ্ধে শিক্ষার মশাল জ্বালতে। আজও শিক্ষার অপেক্ষায় আকুল প্রতিটি অন্ধকার, প্রতিটি নিরক্ষর অস্তিত্ব।

আজ চাকরিহারা শিক্ষা কর্মী যদি বাস্তবিক অর্থে শিক্ষাদানের মহানব্রত পালন করতে চান, তাহলে তিনি অনায়াসেই এটা করতে পারেন। তথাকথিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কি প্রয়োজন? শিক্ষক যদি তার আত্মজ্ঞানের দ্বারা পরশপাথরের চেতনা প্রাপ্ত করেছেন, তাবে তিনি বৃক্ষের তলায় বসে শিক্ষা দান করলেও সেই স্থান হয়ে উঠবে বিদ্যার তীর্থক্ষেত্র।

এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে অর্থনীতির সৌজন্যে, তাহলে শিক্ষকদের ভরণপোষণের কি হবে? এই প্রশ্ন যথার্থ, তবে সদুত্তর তো আছেই। কারণ বৈদিক ঐতিহ্য তথা ভারতীয় সভ্যতা সংস্কৃতি আজও ভুলে যায়নি এক নিবেদিত পরম্পরা- গুরুদক্ষিণা।

কিন্তু হায়! শিক্ষা কোথায়? সেদিন মেধাবী শিশুটি একলা হারিয়ে গেছে পাহাড়ের ওপারে, যেখানে নিবিড় নিসর্গ কিংবা আরো দূরে নক্ষত্রমন্ডলে। সে ফিরে এলে ফের শুধাবে উচ্চ উচ্চারণে- "রাজা তোর কাপড় কোথায়? শিক্ষক তোর শিক্ষা কোথায়"?

আজ চারিদিকে শুধু শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের আয়োজন এবং নিযুত শিক্ষাকর্মী। এদেরই পৃষ্ঠপোষণে তথা বেতন দিতে গিয়ে রাজকোষ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়। অথচ প্রতিদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিক্ষার্থীরা কি প্রাপ্ত করে? একদিকে শিক্ষা কর্মীদের অবহেলা কিংবা অজ্ঞতা, অন্যদিকে পুঁথিপত্রের জড়বিদ্যা শিশুর চেতনাকে নষ্ট করে দেয়। পরম্পরায় প্রাপ্ত শিশুর স্বনির্ভরশীল হয়ে ওঠার সক্ষমতাকে নষ্ট করে দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীরা প্রকৃত শিক্ষা পায় না, পরন্তু তাদের জন্মগত মেধা ও মননশীলতাকে তিলে তিলে নষ্ট করে দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীকে মানসিকভাবে গোলাম বানিয়ে দেওয়া হয়।

তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত একটি অর্থহীন দস্তাবেজ সম্বল করে তাকে অসহায়ের মতো ঘুরে বেড়াতে হয় চাকরি পাওয়ার আশায়। সে চাকর হতে চায় কোনো পুঁজিপতির অধীনে, কিংবা সে হতে চায় সরকারি কর্মচারী অর্থাৎ শাসকগোষ্ঠীর অনুগত দাস।
যুব সম্প্রদায়ের এই নিদারুণ পরিণতি কি এক মহান রাষ্ট্রের পক্ষে লজ্জাজনক নয়? প্রিয় সন্তানের এই অসহায় পরিণতি কি পিতা-মাতাকে গভীর পীড়া দেয় না?
তাহলে তথাকথিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাকর্মী তথা আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা কি একটি গভীর ছলনা নয়? 
                                 ~ রাম রানা

মন্তব্যসমূহ