লিভারের বিভিন্ন রোগের জন্যে কিছু উপকারী ভেষজ:

লিভারের রোগ সিরোসিস, হেপাটাইটিস, ক্যান্সার, ফ্যাটি লিভার ও জন্ডিস সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা:

লিভার আমাদের শরীরের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যা বিভিন্ন জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। লিভারের কার্যকারিতা ব্যাহত হলে নানা ধরনের রোগ দেখা দিতে পারে।

লিভারের প্রধান রোগগুলি সম্পর্কে লিখে আলোচনা করা হলো:

* হেপাটাইটিস (Hepatitis): লিভারের প্রদাহকে হেপাটাইটিস বলে। এটি ভাইরাস, অ্যালকোহল, ওষুধের প্রভাবে হতে পারে।

* সিরোসিস (Cirrhosis): দীর্ঘস্থায়ী লিভার ক্ষতির কারণে লিভারে ক্ষত তৈরি হলে তাকে সিরোসিস বলে। এতে লিভারের কার্যক্ষমতা হ্রাস পায়। অ্যালকোহল, দীর্ঘস্থায়ী হেপাটাইটিস বি বা সি, নন-অ্যালকোহলিক স্টিয়াটোহেপাটাইটিস (NASH) সিরোসিসের প্রধান কারণ।

* ফ্যাটি লিভার (Fatty Liver Disease): লিভারে অতিরিক্ত চর্বি জমা হওয়াকে ফ্যাটি লিভার বলে। এটি দুই প্রকারের হতে পারে- অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার (Alcoholic Fatty Liver), যা অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে হয়। নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার (Non-alcoholic Fatty Liver Disease - NAFLD), মদ্যপান ছাড়াই যখন লিভারে চর্বি জমে।

* লিভার-ক্যান্সার (Liver-Cancer): লিভারে অস্বাভাবিক কোষের বৃদ্ধি ঘটলে লিভারে ক্যান্সার হয়। সিরোসিস দীর্ঘস্থায়ী হলে লিভার-ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।

* জন্ডিস (Jaundice) জাতীয় উপসর্গ: ত্বক ও চোখের সাদা অংশ হলুদ হয়ে যাওয়া। এটি বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে হয়।

এমতাবস্থায় যদি কারোর লিভারে হয়ে থাকে সিরোসিস, হেপাটাইটিস, ক্যান্সার, চর্বি সঞ্চয় (ফ্যাটি লিভার) বা জন্ডিস জাতীয় সমস্যা- যাই হোক না কেন, নিছক আতঙ্কিত হওয়ার কোন কারণ নেই। যেহেতু লিভারের রোগ থেকে খুব সহজে আরোগ্য লাভ করা যায়।

লিভার কেবল এক মাংসখন্ড নয়, বরং মানবদেহের অনন্য অস্তিত্ব। নিজেকে সারিয়ে তোলার অসাধারণ ক্ষমতা রাখে লিভার, যা কিনা তার প্রবল পুনরুৎপাদন ক্ষমতা (Regenerative capacity)। আসুন একটি গল্পের মাধ্যমে বিষয়টা বুঝে নেওয়া যাক। নিচে গল্পটি উল্লেখ করা হলো:

প্রাচীন গ্রীক পুরাণে উল্লেখ আছে যে, প্রমিথিউস নামে এক ব্যক্তিকে ককেশাস পাহাড়ের উপরে লোহার শিকলে হাত পা বেঁধে রাখা হয়েছিল। প্রতিদিন একটি ঈগল পাখি প্রমিথিউসের লিভার খুবলে খুবলে খেত। কিন্তু তার লিভারটি পুনরায় স্বাভাবিক আকারে গড়ে উঠতো।
এই গল্পটির মধ্যে লুকিয়ে আছে দেহতত্ত্ব বা উন্নত চিকিৎসা-বিজ্ঞান। হাজার হাজার বছর পূর্বে প্রাচীন মানুষরা জেনেছিলেন লিভারের অদ্ভুত পুনরুৎপাদন শক্তির কথা। যদি লিভারের বিরাট অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা কেটেছিঁড়ে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়, তবুও লিভারের অবশিষ্ট অংশ নতুন কোষ (Hepatocytes- stem cells) সৃষ্টি করে পূর্বের পূর্ণ আকারে ফিরে আসতে সক্ষম। অতএব লিভারের রোগীও অনায়াসে আরোগ্য লাভ করতে পারেন। এক্ষেত্রে প্রয়োজন সঠিক পথ্য ও ভেষজ ঔষধ:

সঠিক পথ্য- সকালের প্রাতরাশ করতে হবে শুধুমাত্র ফলমূল সহযোগে, এছাড়া অন্য কোনো খাদ্যবস্তু নয়।দ্বিপ্রহরের অন্ন ভোজনের ঠিক পূর্বে কাঁচা সবজি বা স্যালাড খেতে হবে, টমেটো শসা বিট গাজর মুলো ইত্যাদির মধ্যে যেকোনো দু'এক প্রকার সবজি সহযোগে। পরিমাণ ৩০০-৪০০ গ্রাম প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে। অনেকের মনে হতে পারে এতটা সবজি মানে অনেক বেশি। কিন্তু মনে রাখবেন যে- কাঁচা সবজির মধ্যে ৮০% - ৯৫% বিশুদ্ধ জলীয় পদার্থ উপস্থিত থাকে, অর্থাৎ ৪০০ গ্রাম সবজির মধ্যে কঠিন অংশ ৫০-১০০ গ্রাম। কাঁচা সবজি খাওয়ার পরেই রান্না করা অন্ন খেতে হবে। দ্বিপ্রহরের মতনই রাতের ভোজনও।
রান্নায় খুব অল্প তেল মশলা ব্যবহার করা যেতে পারে। মাছ মাংস দুধ ঘি ডিম এবং কারখানায় প্রস্তুত যাবতীয় খাদ্যবস্তু বর্জন করতে হবে।
যারা খুব বেশি অসুস্থ তাদের রাতের খাবারে শুধুমাত্র কাঁচা সবজি বা ফলমূল থাকবে, রান্না করা অন্ন বাতিল করা হয়। তবে রাতের অন্ন বাতিল প্রথম ১৫ দিন পর্যন্ত। তারপর অবশ্যই রাতে অন্ন গ্রহণ করতে পারেন।
ঠিক এইভাবে যদি শরীরকে সাপোর্ট দেওয়া হয় তাহলে খুব দ্রুত অসুস্থ লিভার পুনরায় সতেজ ও সবল হয়ে উঠবে, অতঃপর রোগী সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করবেন। মনে রাখবেন যে, এই প্রাকৃতিক আহার হলো মনুষ্যের প্রকৃত আহার। অতএব প্রতিদিন আমাদের বিকৃত খাদ্যাভ্যাসের বদলে এই প্রকৃত খাদ্যাভাস গড়ে তুলতে হবে। কারণ এই খাদ্যাভ্যাস যেমন রোগীকে আরোগ্য প্রদান করে, তেমনি নীরোগ মানুষকেও সারা জীবন রোগ-জীবাণুর আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত রাখে এবং দীর্ঘজীবনের সহায়ক।

উপকারী ভেষজ ঔষধ, যেমন-

পেঁপেপাতা- লিভারকে সুস্থ করে তুলতে একটি উপকারী ভেষজ ওষুধ। প্রত্যহ প্রত্যুষে পেঁপের পাতা থেকে প্রায় ৫০-১০০ ml রস বার করে পান করতে হবে ৭ দিন পর্যন্ত। যাদের জন্ডিস বা হেপাটাইটিস হয়ে গেছে তারা পেঁপেপাতা ব্যবহার করবেন। কিন্তু পেঁপেপাতা সকল লিভার-রোগীর জন্য উপকারী।
লিভারের পক্ষে পেঁপের পাতা বিভিন্ন উপায়ে কার্যকরী হতে পারে। এর প্রধান কারণ হল এতে থাকা বিভিন্ন বায়োঅ্যাকটিভ যৌগ (Acetogenins), এনজাইম (Chymopapain, Papain), অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (Vitamin C, E) এবং মিনারেলস। যা কিনা অসুস্থ লিভারকে পুনরায় সুস্থ ও সবল করে তুলতে সহায়ক।

লবঙ্গ- যাদের লিভারের সিরোসিস হয়েছে তাদের জন্য উপকারী হলো লবঙ্গ। লবঙ্গ সিরোসিসের উপসর্গ কমাতে এবং ফ্যাটি লিভারের সমস্যা দূর করতে সহায়ক। এটি শরীর থেকে ক্ষতিকারক র্যাডিকেল দূর করে। ৪-৫ টি লবঙ্গ প্রায় এক গ্লাস জলে সারারাত ভিজিয়ে রেখে সকালে সেই জল পান করা যায়, অথবা দু'একটি লবঙ্গ সরাসরি চিবিয়ে চিবিয়ে খাওয়া যেতে পারে।

রসুন- যাদের ফ্যাটি লিভারের সমস্যা আছে তাদের জন্য উপকারী হল রসুন। রসুন লিভারে জমে থাকা চর্বি কমাতে এবং লিভারকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে সহায়ক। এটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গুণ সম্পন্ন। দু-একটি রসুন চিবিয়ে খাওয়া যেতে পারে প্রত্যহ সকালে।

হলুদ- যাদের লিভারে ক্যান্সার হয়েছে তাদের জন্য উপকারী হল হলুদ। হলুদে কারকিউমিন নামক একটি উপাদান থাকে যা লিভারের প্রদাহ কমাতে এবং ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়ক। এটি লিভারের চর্বি কমাতেও সাহায্য করে। কাঁচা হলুদ প্রায় ৫-৬ গ্রাম পরিমাণ চিবিয়ে খাওয়া যেতে পারে প্রত্যহ, ১৫ দিন পর্যন্ত।

লিভারের রোগের ক্ষেত্রে এই চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হলে আপনাকে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞের বা অভিজ্ঞ কবিরাজের পরামর্শ নিতে হবে।

Medical disclaimer-
এই প্রতিবেদনে প্রদত্ত তথ্য শুধুমাত্র স্বাস্থ্য বিষয়ে শিক্ষামূলক উদ্দেশ্যে উপস্থাপন করা হয়েছে। আতএব কোনো রোগের চিকিৎসা ও ওষুধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
                  ~ রাম রানা

মন্তব্যসমূহ