মানুষ ও ভগবান:
মানুষ ও ভগবান:
মানুষের আদিম চেতনা থেকে আজও অমীমাংসিত এক প্রশ্ন, কারণ উত্তর বারবার বদলে গেছে যুক্তিতর্কে অথবা দুর্বিচারে। কিন্তু বিশ্বাসী মনে বা অবিশ্বাসে আবার জেগে ওঠে সদুত্তরের স্পৃহা, অন্তর থেকেও অনন্ত বহির্জগতে তার অন্বেষণ-
তাই সে সাজিয়েছে আস্থার গভীরে অর্চনা, আবার বিরুদ্ধাচরণও ঢেলেছে বিষ। কখনো সে বুনেছে দর্শনের যুক্তি কিংবা যাচাই করেছিল বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণে, কেউ ডুবে গেছে হৃদয়ের অতলে ভাবের টানে, কেউবা একলা ফেরে উপাসনার উপত্যকায়। আবার যিনি প্রজ্ঞায় স্থিত তিনি তো নীরব- এক অনুপম অস্তিত্ব।
তবে ঈশ্বর কি অন্তরালে অনুভব নাকি মহাকাশের ওপারে মহাশক্তি? ঈশ্বর কি প্রতিটি অস্তিত্বের চৈতন্য নাকি অখণ্ড বিখণ্ড সৃষ্টির সৃষ্টিকর্তা? ঈশ্বর যদি পুষ্পের পাপড়ির রচনাকার, তবে কি প্রলয়কালেও মহাকাল দোর্দণ্ডপ্রতাপ? ঈশ্বর কি অন্ধকারের গভীরে নিবিড় কালিমা অথবা অগণিত নক্ষত্রের বুকে অনির্বাণ অগ্নিশিখা?
বিজ্ঞানের ভিত্তি হল পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ, তারপর সিদ্ধান্ত। কিন্তু হায়, বিজ্ঞানের যান্ত্রিক প্রয়াসে ঈশ্বরকে পর্যবেক্ষণ করা যায়নি, অতএব সিদ্ধান্ত দিতে বিজ্ঞান অক্ষম। বরং একটা বিন্দুতে এসে বিজ্ঞানের সকল জড়বিদ্যা ফুরিয়ে যায়- আত্মসমর্পণ করে। যেমন, একদা রিডাকশনিস্ট সায়েন্স পৌঁছে গিয়েছিল বিগ ব্যাং- এর তত্ত্বে। আবার সে নিরুত্তর- বিগ ব্যাং এর প্রথম মুহুর্তে কিভাবে সৃষ্টি হয়েছিল "মহাসংকোচন"? আদি শক্তির সঞ্চয় ও সঞ্চালন হয়েছিল কিভাবে? এর উত্তর দিতে পারেনি পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ তথা পন্ড পরিশ্রম।
কিন্তু মহাপ্রাজ্ঞ ঋষিগণ নিশ্চিত করেছেন অমোঘ সত্য- কে সেই পরমাত্মা অথবা "শব্দব্রহ্ম"। শব্দে শব্দে ব্রহ্মাণ্ডের সঞ্চার। এক পরম বিন্দু হতে মহাবিস্ফুরণের শব্দতরঙ্গে সৃষ্টি হয়েছে অখন্ড মন্ডলাকার ব্রহ্মাণ্ড, অতঃপর তার প্রতিটি খণ্ড বিখণ্ড প্রাপ্ত করেছে আকার। প্রতিটি আকৃতির অভ্যন্তরে আজও বেজে চলেছে নিরন্তর এক শব্দ-কম্পন। এই শাশ্বত সত্যকে মেনে নিয়ে আধুনিক বিজ্ঞান বলেছে "Everything is vibration". যেমন তোমারও হৃদয়ে নিষণ্ণ এক মৃদুল স্পন্দন, যা কিনা প্রাণের গভীরতম গুঞ্জন।
তুমি হয়তো ঈশ্বরের অস্তিত্ব খণ্ডন করতে পারো যুক্তি দ্বারা বা দুর্বিচারে। তার গণ্ডির সীমানায় এসে বিজ্ঞান যদি নতজানু হয়ে পড়ে, তাহলে তুমি ঈশ্বরকে অস্বীকার করে নিঃসংশয় থাকতে পারবে কি? ক্লান্তজীবন কি বার বার ঈশ্বরের উপান্তে ঝুঁকে পড়ে না? ঈশ্বরের অনুকম্পাই কি তোমার হৃদয়ের অনুপম উপহার নয়?
ঈশ্বর আমাদের বিচারে অচিন, আবার নির্বিচারে অতীন্দ্রিয়, পর্যবেক্ষণে প্রমাণযোগ্য নয়, মূর্ত ধারণায় যা ধাতব চিত্রায়ন কিংবা সুসজ্জিত প্রস্তর খণ্ড, আবার চক্ষুর অন্তরালে বিমূর্ত বিশ্বাস, হয়তো অন্তরের অপার অনুভূব।
প্রতিটি সুখকর মুহূর্তে হৃদয়ে তোমার আনন্দের হিল্লোল তুলেছে কে? পরাজয়ের প্রতিটি মুহূর্তে অস্থির অন্তরকে শান্ত করেছিল কে- ঈশ্বরের স্নিগ্ধ স্পর্শ নয় কি? অন্যথায় কেবা তোমাকে ঘুম পাড়াতো?
মাতৃজঠরে তুমি যখন এক ছোট্ট ভ্রূণ রূপে অন্ধ ছিলে, তখন তোমার আলোক উদ্ভাসিত নয়ন যুগল নির্মাণ করে দিয়েছিল চুপিচুপি কোন কারিগর? তখন তোমারও কোমল হৃদয়ে প্রাণ সঞ্চার করেছিল কে?
এই মহাজগতে কে উত্তোলন করেছে উদ্ভাসিত আলো? যে আলো আমাদের চোখের উজ্জ্বল দর্শন। কে সৃষ্টি করেছেন মৃদুল আঁধার? যে আঁধার দু' চোখের পাতায় ছুঁয়ে দেয় গভীর বিশ্রাম, অতঃপর নিঝুম ঘুম। তখন হয়তোবা কোনো বিস্মৃত অতীতের রোমাঞ্চ ফিরে আসে স্বপ্নের সাজে, কেউ কি বলতে পারে যে- সেই বর্ণাঢ্য স্বপ্নের কারিগর কে?
না, আর কোনো প্রশ্ন নয়, উত্তর নয়, প্রমাণও নয়। বরং তোমার আত্মজ্ঞানই অনুভব করতে পারে ঈশ্বরের উপস্থিতি বা অস্তিত্ব, তবে চলো কোনো প্রাচীন বৃক্ষের মূলে পদ্মাসনে হয়তো এক যুগ যাবৎ নিস্তব্ধতা-
ঈশ্বর যদি বস্তু আধারিত বাস্তবিকতা না হয় তবে তার উপস্থিতির প্রমাণ কে দিতে পারে? তিনি কি অসীম কালচক্রের স্রষ্টা? যে কালচক্রে জন্মগ্রহণ করে এবং বিনাশে বিলীন হয় প্রতিটি জাড্য, প্রতিটি জৈবিক অস্তিত্ব। তিনি কি মহাশক্তির প্রযোজক? যে শক্তির সুশৃঙ্খলে আবদ্ধ প্রতিটি গ্রহ নক্ষত্র তথা সকল প্রবাহ। সৃষ্টির অস্তিত্ব যদি প্রকট, তাহলে তার পরম স্রষ্টা কি নেই?
~ রাম রানা
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন