মানুষের পেটে অ্যাসিডিটি বা অম্বল কেন হয়?

মানুষের পেটে অ্যাসিডিটি বা অম্বল কেন হয়?
মানুষ তথা প্রতিটি প্রাণীকে খাদ্য খেতেই হয়, অন্যথায় জীবনের অস্তিত্ব টিকে থাকতে পারে না। কারণ শরীরকে শক্তি প্রদান করে খাদ্য। কিন্তু এই খাদ্য যদি হজম না হয় তাহলে চরম বিপত্তি ঘটবে। তাইতো শরীরের অভ্যন্তরে রচিত হয়েছে অনন্য পৌষ্টিকতন্ত্র বা হজমের প্রকৌশল। চর্ব্য চোষ্য লেহ্য পেয় যেভাবে গ্রহীত করা হোক না কেন, খাদ্য প্রথমে পৌঁছে যায় পেটে বা পাকস্থলীর মধ্যে। এখান থেকেই খাদ্য হজমের মূল প্রক্রিয়া শুরু হয়। যেমন-
* পাকস্থলী থেকে নিঃসৃত হয় গ্যাস্ট্রিক অ্যাসিড (HCI), যা কিনা খাবার হজমের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এই অ্যাসিড খাবারের মধ্যে থাকা প্রোটিনকে ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে পরিণত করে। এভাবে খাদ্যকে ভেঙে ফেলার মানে হল হজমের প্রাথমিক ও প্রধান শর্ত। আবার এই অ্যাসিড খাদ্য হজমে সাহায্যকারী এনজাইমকে অধিক কার্যকরী করে তোলে, যেমন নিষ্ক্রিয় পেপসিনোজেনকে সক্রিয় পেপসিনে রূপান্তর করে দেয়। তারপর সক্রিয় এনজাইম খাদ্য হজমে সাহায্য করে অর্থাৎ খাদ্যের প্রোটিন ফ্যাট ও কার্বোহাইড্রেট জাতীয় পুষ্টি উপাদান সমূহকে ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণায় রূপান্তর করে। তখন ক্ষুদ্র খাদ্যকণা বা পুষ্টিকণা গুলোকে অন্ত্র শোষণ করতে পারে। এইভাবে খাদ্য সম্পূর্ণ হজম হয় বা পরিপাক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
* এছাড়াও যদি গৃহীত খাদ্যের সঙ্গে কোন ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু পেটে চলে যায় তখন তাকে নষ্ট করে দেয় গ্যাস্ট্রিক এসিড।
তাহলে ভেবে দেখুন যে, এই এসিড মানব শরীরের পক্ষে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ও উপকারী।

এখন প্রশ্ন হলো যে, কখনো কখনো কেন অ্যাসিডের উপসর্গ দেখা যায়? যেমন,
গ্যাস্ট্রিক এসিডের ক্রিয়ার ফলে বুকের ভিতরে হালকা জ্বালা করে, গলাতেও আম্লিক অনুভূতি হতে পারে। এই পরিস্থিতি তৈরি হয় তখন, যখন পাকস্থলী অতিরিক্ত গ্যাস্ট্রিক অ্যাসিড নিঃসরণ করে।

কিন্তু পাকস্থলী অতিরিক্ত অ্যাসিড নিঃসরণ করে কেন?
এর উত্তরে বলা যায় যে, আমরা যদি এমন খাদ্য গ্রহণ করি বা এমন পরিস্থিতিতে খাদ্য গ্রহণ করি যা কিনা খুব সহজে হজম হয় না, সেটিকে হজম করতে অতিরিক্ত গ্যাস্ট্রিক অ্যাসিডের প্রয়োজন হয় তখন পাকস্থলী অধিক অ্যাসিড নিঃসরণ করে। কিন্তু এটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও হিতকারী প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে খাদ্য সম্পূর্ণভাবে হজম হয়।

অতএব পেটের এসিডিটি বা অম্বল কোন রোগ নয়, বরং এটি শুভ সংকেত। অর্থাৎ খাদ্য হজমের অনন্য প্রয়াস। কিন্তু মানুষ তার শরীরের এই শুভ সংকেত সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারেনা, দেহতত্ত্বের গভীরতা বুঝে উঠতে পারে না। তাই পেটে এসিডিটি বা অম্বল হলে আমরা ভুলবশত এটিকে রোগ বলে কল্পনা করি।
এমতাবস্থায় যদি কেমিক্যালযুক্ত ড্রাগস প্রয়োগ করে গ্যাস্ট্রিক এসিডের মাত্রা কমিয়ে দেওয়া হয় বা অ্যাসিডকে নষ্ট করে দেওয়া হয়, তাহলে এটি কি বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্ত? এইভাবে কেমিক্যাল পদার্থ প্রয়োগ করা কি শরীরের পক্ষে হানিকারক নয়?

মূল সমস্যাটি হলো আমাদের ত্রুটিপূর্ণ খাদ্যাভ্যাস ও অস্বাস্থ্যকর জীবনধারা, যেমন-
* গুরুপাক খাবার- অধিক তেল মসলাযুক্ত, ভাজাপোড়া ও চর্বিযুক্ত খাবার হজম করতে পেটে এসিডের নিঃসরণ বেড়ে যায়।
* অসময়ে খাবার- প্রকৃত খিদে না পাওয়া সত্ত্বেও মানুষ খাবার খায়। কারণ মানুষ ঘড়ি ধরে খাবার খায় বা নির্দিষ্ট সময় অনুসারে খাবার খায়। এটিই হলো অসময়ের খাবার, এটি বদহজমের কারণ। খিদে না লাগার অর্থ পেটের ভিতরে তখনো পূর্বের কিছু অপাচ্য খাদ্য পড়ে আছে। অতএব যখন পূর্ণ খিদে পাবে তখনই খাদ্য গ্রহণের উপযুক্ত সময়।
* অতিরিক্ত খাবার- অনেক সময় লোভনীয় বা সুস্বাদু খাবার রসনার তাড়নায় অতিরিক্ত খাওয়া হয়ে যায়, যা কিনা হজম করতে অতিরিক্ত এসিডের প্রয়োজন পড়ে।
* ধূমপান ও মদ্যপান- ধোঁয়া ও অ্যালকোহল এই দুটির প্রভাবে খাদ্যনালী ও পাকস্থলীর সংযোগস্থলের সংবেদনশীল পেশী দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন এই দুর্বল বাধা অতিক্রম করে গ্যাস্ট্রিক এসিড অল্প পরিমাণে ছড়িয়ে পড়ে খাদ্যনালীর ভিতরে। এটিই এটিই হলো বুকের মধ্যে ও গলায় হালকা জ্বালা বা আম্লিক সংকেত।
* অধিক রাত জাগরণ ও বেশি রাতে ভোজন- এই দুটি অভ্যাস পরিপাকতন্ত্রের ক্ষতি করে।
* মানসিক চাপ- দীর্ঘস্থায়ী দুশ্চিন্তা হতাশা বা অবসাদ স্বাভাবিক হজমের প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে, তখন অতিরিক্ত এসিড নিঃসরণ হয়।
* চা, কফি, জাঙ্কফুড বা কলকারখানায় প্রস্তুত সকল খাদ্যবস্তু- এগুলো পরিপাকতন্ত্রের ক্ষতিসাধন করে। পেটে আম্লিক পরিস্থিতি তৈরি হয়।
* কেমিক্যাল যুক্ত মেডিসিন- যেমন অ্যান্টি ইনফ্লামেটরি ড্রাগস ও পেন কিলার জাতীয় মেডিসিন ব্যবহার করলে হজমজনিত বিপত্তি দেখা যায়। তখন গ্যাস্ট্রিক এসিডের মাত্রা বাড়তে পারে।
* Antacids, PPls- এই জাতীয় বিভিন্ন মেডিসিন পেটের এসিডিটিকে কেন্দ্র করে ব্যবহার করা হয়। এর ফলে পরিপাকতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়, খাদ্য হজমে ব্যাঘাত ঘটে। তখন এসিডের নিঃসরণ বেড়ে যায়।

অতএব উপরে উল্লেখিত পরিস্থিতি গুলো থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও সুস্থ জীবনধারা গড়ে তুলতে হবে। তাহলে হজমের কোন সমস্যা হবে না, পরিপাকতন্ত্রও পুনরায় সবল হয়ে উঠবে।

Medical disclaimer-
এই প্রতিবেদনে প্রদত্ত তথ্য শুধুমাত্র স্বাস্থ্য সম্পর্কে শিক্ষামূলক উদ্দেশ্যে সংকলন করা হয়েছে। আতএব কোনো রোগের চিকিৎসা ও ওষুধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরী।
                      ~ রাম রানা

মন্তব্যসমূহ